আহমেদ বায়েজীদ : ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ ঘিরে বিশ্বরাজনীতি এখন টালামাটাল। ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের সামরিক অভিযান ও এর জের ধরে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলায় পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। ক্রমশ উঁচু হচ্ছে লাশের স্তুপ, আহত আর স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারি হচ্ছে পরিবেশ। রাজনীতি আর কূটনীতির মাঠও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এই যুদ্ধ ঘিরে।
যথারীতি এখানেও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিভক্তির সমীকরণ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমারা যখন ‘আত্মরক্ষার’ নামে ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে যুদ্ধ চালানোর উস্কানি দিচ্ছে, প্রাচ্য তখন চাপ দিচ্ছে যুদ্ধ থামানোর জন্য।
আরব দেশগুলোতে ঘুরে ঘুরে ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেও সফল হননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বরং উল্টো আরবদের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে যুদ্ধ বন্ধ করতে। যে কারণে ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সামরিক সহযোগিতা পাঠানো, অন্য দেশগুলোকে চাপে রাখতে বিমানবাহী রণতরীসহ ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠানোসহ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চেষ্টাও তারা চালাচ্ছে। আরবরা হামাসের পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষায় তাদের তৎপরতা টের পাওয়া যাচ্ছে। অ্যান্টনি ব্লিংকেন ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ‘ম্যানেজ’ করতে।
এমন বড় ও উত্তেজনাকর একটি সঙ্কটে বিশ্বের বৃহৎ দুই শক্তি চীন, রাশিয়া বসে থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। যদিও তারা সরাসরি মাঠে নামেনি, তবে সাইড লাইনে তাদের জোর তৎপরতা টের পাওয়া যাচ্ছে। উভয় দেশই হামাসের সামরিক অভিযানের নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে। তারা ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধের জন্যও চাপ দিচ্ছে। পাশাপাশি গাজার নিরীহ মানুষদের হত্যা বন্ধ করতে কণ্ঠ জোরালো করেছে। যা ইসরায়েলের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব বলয় থাকলেও গত কয়েক বছরে তাতে ভাগ বসিয়েছে রাশিয়া ও চীন। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে অনেকগুলো ইস্যুতে। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মস্কো ও বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের পদচিহ্ন ক্রমশই স্পষ্ট করতে শুরু করেছে। রিয়াদ, আবুধাবির সাথে তাদের সম্পর্কের দহরম-মহরম না চললেও সেটি যে উষ্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে তাতে সন্দেহ নেই। ওয়াশিংটনের সাথে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে মস্কো-বেইজিংয়ের যে প্রতিযোগিতা সেটাই এখানে আসল কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি ফিলিস্তিন ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থানকে প্রভাবিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে নেমেছে, সেক্ষেত্রে এই দুটি দেশ ভিন্ন পদক্ষেপ নেবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের সাথেও তাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। মাও সে তুংয়ের যুগ থেকেই ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধানের বিষয়ে কথা বলে আসছে চীন। তারা বরাবরই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। যথারীতি এবারও একই কথা বলেছে বেইজিং। রাশিয়ার ভূমিকা অনেকটা একই ধরনের। গাজায় ইসরায়েলি অবরোধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেলিনগ্রাদে হিটলার বাহিনীর অবরোধের সাথে তুলনা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এখানে মনে রাখতে হবে, এই দুটি দেশের কেউই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। বরং তারা হামাসকে দেখছে বৈধ প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান ও ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান চায় তারা।
দেশ দুটির এই অবস্থান পছন্দ হয়নি ইসরায়েলের। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুসালেম পোস্ট তাদের অবস্থানকে ‘ওপেনলি হস্টাইল টু ইসরায়েল’ অর্থাৎ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তেল আবিব আশা করেছিল, যেহেতু তাদের সাথে মস্কো ও বেইজিংয়ের সুসম্পর্ক রয়েছে, তাই ভ্লাদিমির পুতিন ও শি চিনপিংও ইসরায়েলের পক্ষ নেবেন; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি দেখেই বিষয়টিকে তারা ‘শত্রুতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করেনি। দেশ দুটির ওপর ইসরায়েলি ক্ষোভ যে জমা হয়েছে তা কিছুটা হলেও টের পাওয়া যায় এ থেকে।
দুটি দেশই যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। চীনের বেল্ট এন্ড রোড ফোরামে ভ্লাদিমির পুতিনের অংশগ্রহণ উপলক্ষে এ সপ্তাহেই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে বৈঠক হবে। সেই বৈঠকেও সব কিছু ছাপিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যু প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেখান থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিও আসতে পারে। দেশ দুটি অঞ্চলটির বিষয়ে আরো জোরালোভাবে মাঠে মানতে পারে এমন ধারণা করা হচ্ছে।
সঙ্ঘাত নিয়ে চীন-রাশিয়া যে অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ অবশ্যই। তবে তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রামেও তা জ্বালানি যোগাবে। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক দিন ধরেই অবস্থান জোরালো করতে চাইছে চীন ও রাশিয়া। গাজা-ইসরায়েল সঙ্ঘাত তাদের সেই অবস্থান আরো মজবুত করার সুযোগ করে দিতে পারে। অন্য দিকে দুর্বল হতে পারে মার্কিন অবস্থান। আর দুই পক্ষের এই লড়াইয়ে মাঝখান থেকে সুবিধা পেতে পারে ফিলিস্তিন।
ইউক্রেন যুদ্ধ বা তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ আরো কিছু বিষয়ে পশ্চিমাদের সাথে মাধ্যপ্রাচ্যের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ইউক্রেনের যুদ্ধের মাঝখানেই দেশগুলো প্রকাশ্যে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আবার চীনের মধ্যস্ততায় সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে ইরান ও সৌদি আরব। এসব কিছুই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবে ভাগ বসানোর আলামত। এবারের গাজার যুদ্ধকে যে চীন-রাশিয়া তাদের এই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে বেশি করে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে সেটি বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। প্রভাবশালী পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গ তার এক নিবন্ধের শিরোনাম করেছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জিতবে শুধু চীন-রাশিয়া’। অর্থাৎ এই সঙ্ঘাতে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যাকফুটে রয়েছে সেটি পশ্চিমারাও স্বীকার করতে শুরু করেছে।
সঙ্ঘাতকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই বিশ্ব দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল আর তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। অন্য দিকে আরব বিশ্বসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। চীন-রাশিয়াও দ্বিতীয় পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থান নিয়ে বড় ধরনের বেকায়াদায় পড়েছে। মাকির্ন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠক স্থগিত করেছেন জর্ডান, মিসর ও ফিলিস্তিনের নেতারা। বাইডেনের জর্ডান সফরও বাতিল হয়েছে। এর আগে ব্লিংকেন ছয় দেশে দৌড়ঝাঁপ করেও কিছু আদায় করতে পারেননি; অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যে না এসেও অনেক কিছুই হয়তো পেয়ে যাচ্ছেন শি চিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন।
এখন বেইজিং ও মস্কো এই লড়াইয়ে কোন পদ্ধতিতে খেলবে সেটি বোঝা কঠিন। রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ইরানের। অঞ্চল জুড়ে ইরানের রয়েছে একাধিক প্রক্সি মিলিশিয়া বাহিনী। চাইলে এই বাহিনীগুলোকে সহজেই কাজে লাগাতে পারবে রাশিয়া। ইতোমধ্যেই হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর অল্প পরিসরে আক্রমণ চালাচ্ছে। সেটা যে কোনো সময় পূর্ণমাত্রায় শুরু হতে পারে। যদিও ইসরায়েল বলেছে, তারা এই মুহূর্তে উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধে নামতে চায় না, কিন্তু হিজবুল্লাহ চাইলে তারা নামতে বাধ্য হবে। হিজবুল্লাহর পদক্ষেপের পেছন থেকে মস্কো কলকাঠি নাড়তে পারে। কাজেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিপাকে ফেলতে মস্কো এই কার্ড খেলবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মার্কিন-বিরোধী জনমত চাঙ্গা হচ্ছে। সেটিও কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে চীন-রাশিয়া। এমনিতেই অঞ্চলটির জনগণের মাঝে ইসরায়েলের সূত্র ধরে মার্কিন বিদ্বেষ সক্রিয় রয়েছে। গাজা উপত্যকায় লাশের স্তুপ দেখে সেটি আরো বাড়ছে। তাই তেল আবিবের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আরব জনগণের হৃদয়ে ঢোকার এই সুযোগ নিতে চাইবে রাশিয়া। যে কারণে ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানে তারা নতুন করে এগিয়ে আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা বা এক তরফাভাবে ইসরায়েলকে মদদ দেয়ার কারণে সেটি কতটা সম্ভব হবে তা বলা কঠিন। তবে অতিদ্রুত সমস্যার সমাধান না হলেও এই দুটি প্রভাবশালী দেশ ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরো বেশি করে জড়িত হলে তা ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি করবে নিঃসন্দেহে এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও লড়াইয়ে প্রেরণা যোগাবে। আর কিছু না হলেও ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে তা।